সাফিয়া বেগম- শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদের মা


জুরাইন কবরস্থানে গেলে একটি কবরের পরিচয় ফলকের উপর এমন একটি লেখা দেখা যাবে -

মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদের মা

এই লেখা টি শুধুমাত্র একটি সাধারণ লেখা নয়, এটি একজন বীর মায়ের আবেগ।শহীদ সন্তানের প্রতি ভালোবাসা।যে সন্তান দেশমাতা ও জন্মদাত্রী মা উভয়ের জন্য গর্বের।১৯৪৬ সালের ১১ই জুলাই ঢাকা শহরের তৎকালীন সবচেয়ে ধনী পরিবারে জন্ম হয় আজাদের। তখন "আজাদি আজাদি "স্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছিল ভারতবর্ষ। তাই বাবা-মা তার নাম রাখেন আজাদ।আজাদের বাবা পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিয়ে করার করলে আজাদের মা এক কাপড়ে আজাদকে নিয়ে তাদের বাড়ি ছাড়েন।আজাদকে নিয়ে উঠেন মগবাজারের একটি বাসায়। সেখানে সন্তানকে একাই মানুষ করেন এই বীর মা। আজাদ করাচি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।১৯৭১ সালে আজাদের বন্ধুরা যখন আগরতলা থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসে তখন তারা আজাদকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কথা জানায়। তখন আজাদ তাদেরকে বলে "সে তার মায়ের অনুমতি চায় আজাদের এই দুনিয়ায় তার মা ছাড়া কেউ নেই ঠিক তেমনভাবে তার মায়ের আজাদ ছাড়া কেউ নেই "। আজাদ যখন পরবর্তীতে তার মাকে তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কথা জানায় তখন তার মায়ের ভাষ্য ছিল " নিশ্চয়ই, তোমাকে তো আমি আমার জন্য মানুষ করিনি তুমি দেশের জন্য মানুষ হয়েছো"
আজাদ মুক্তিযুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য ক্র্যাক প্লাটুন অংশগ্রহণ ছিল। তখন ঢাকা শহরের কতগুলো সফল অপারেশন সম্পন্ন করে আজাদ।১৯৭১ সালের 30 শে আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে আজাদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় রমনা থানায়।আজাদসহ ঢাকা শহর থেকে আটক হয় ক্র্যাক প্লাটুনের আরো অনেক সদস্য। প্রচন্ড অত্যাচার শুরু করা হয় তাদের উপর। শেষবার যখন সাফিয়া বেগম আজাদের সাথে দেখা করতে যায় রমনা থানায়, তখন বলা হয় "আজাদকে বলুন সে যেন তার সঙ্গীদের সকল তথ্য দিয়ে দেয় তাহলে তাকে রাজসাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং ছেড়ে দেওয়া হবে "। তবে সাফিয়া বেগম উল্টো নির্দেশ দেন আজাদকে, "তিনি আরো বলেন যত কষ্টই হোক না কেন আজাদ যেন কোনো কিছু স্বীকার না করে"।
শেষবার যখন আজাদের তার মায়ের সাথে দেখা হয় তখন আজাদ তার মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিল। তিনি ভাত নিয়ে ছেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তবে তিনি আজাদের দেখা আর পাননি।আজাদের নিখোঁজ হওয়ার পর আরও ১৪ বছর বেঁচে ছিলেন সাফিয়া বেগম। তবে তিনি কোনদিন আর ভাত মুখে তুলে দেখেননি। শেষবার যখন আজাদকে দেখেছিলেন তখন আজাদ মাটিতে শুয়ে ছিলো। জীবদ্দশায় এই মা আর কোনদিন খাটে শোয়নি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শেষে এই মা প্রতিদিন অপেক্ষা করেছে আজাদের ফিরে আসার, কিন্তু আজাদের মায়ের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেনি।১৪ বছর পর, আজাদ যেদিন নিখোঁজ হয় সেই একই দিনে আজাদের মায়ের মৃত্যু হয়।মৃত্যুর আগে তিনি তার বোনের ছেলে জায়েদকে বলে যান তার কবরে পরিচয়ফলকে যাতে বাবা কিংবা তার স্বামীর নাম লেখা না হয়।সেখানে যেন তাকে "শহিদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদের মা পরিচয় দেয়া হয়"।
করাচিতে পড়ালেখার সময় আজাদের তার মাকে লেখা একটি চিঠিতে সে লেখে" যদি আমি তোমার দোয়ায় একদিন বড় কিছু হতে পারি, নামকরা হই,তবে আমি তোমার জীবনী লিখবো"।
আজাদের সেই অপূর্ণ কাজটি করেছেন লেখক আনিসুল হক।আনিসুল হক লিখেছেন, " আজাদ অনেক বড় হয়েছে, এত বড় যে তার সমান আর কেই-বা হতে পারে, নামকরা হয়েছে, এর চেয়ে বেশি নামকরা আর কীভাবে হওয়া যাবে"?
জুরাইন কবরস্থানে এভাবেই বাংলার মুক্ত আকাশে "শহিদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদের মা" পরিচয়ে বেচেঁ থাকুক উৎকীর্ণ বীর মা সাফিয়া বেগম।

Comments

Popular posts from this blog

আমার কাছে স্বাধীনতার মানে

প্রফুল বিলোরে - এমবিএ চা ওয়ালা